logo

শিরোনাম

বাংলাদেশ: গণতন্ত্র, নির্বাচন ও আমাদের ভবিষ্যৎ

Bangalir Kantha
প্রতিবেদন প্রকাশ: ২৫ জুলাই, ২০২৩ | সময়ঃ ১১:৩৭
photo

লেখক: ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো.শামছুল আলম চৌধুরী(অব.) পিএসসি, এমবিএ (জর্জ ওয়াশিংটন ইউনিভার্সিটি, ইউএসএ)
যুক্তরাস্ট্রে বাংলাদেশ দূতাবাসে নিযুক্ত সাবেক কুটনৈতিক

 

গণতন্ত্রই সুন্দর! নির্বাচন গণতন্ত্রের বৈশিষ্ট্যগুলোর মধ্যে সর্বোত্তম। তবে নির্বাচন গণতন্ত্রের একমাত্র শর্ত বা পূর্বশর্ত হতে পারে না। দলীয় সিদ্ধান্ত গ্রহণে গণতান্ত্রিক চর্চা, রাষ্ট্রের সব পর্যায়ে জনমতের প্রতিফলন, মতপ্রকাশের স্বাধীনতা, অসাম্প্রদায়িক সমাজব্যবস্থা, রাষ্ট্রযন্ত্রের সেবাগুলো জনগণের দোরগোড়ায় পৌঁছানো, সম্পদের সুষম বণ্টন ও বিদেশ নীতিতে সার্বভৌম অবস্থান বজায় রাখার মতো বিষয়গুলোও গণতন্ত্রের শক্তিশালী উপাদানগুলোর মধ্যে অন্যতম। গণতন্ত্রের এ উপাদানগুলো বাংলাদেশ এরই মধ্যে উল্লেখযোগ্য মাত্রায় অর্জন করেছে।

গণতন্ত্র একদিকে যেমন জবাবদিহি নিশ্চিত করে, তেমনি জনকল্যাণে জনপ্রতিনিধিদের সিদ্ধান্তসমূহ বাস্তবায়নে আমলাতন্ত্রকে বাধ্য করে। গণতন্ত্র প্রতিযোগিতামূলক নির্বাচনে জনপ্রতিনিধিদের গুণগত মান নিশ্চিত করে ও রাষ্ট্রযন্ত্র পরিচালনায় সরকার ও বিরোধী দলগুলোর মধ্যে আস্থার সৃষ্টি করে। সবকিছু মিলে গণতন্ত্র একটি দেশে শক্তিশালী সরকার গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। শক্তিশালী সরকার একটি জাতির উন্নয়ন, নিরাপত্তা ও অর্থনৈতিক ভবিষ্যৎ বিনির্মাণে একমাত্র চালিকাশক্তি। প্রশ্ন হলো, ‘বাংলাদেশে কি গণতন্ত্র আদৌ বিরাজমান?’ এক কথায় উত্তর হলো, ‘অবশ্যই।’ তাহলে বাংলাদেশে গণতন্ত্রের অবস্থান কোথায়? যুক্তরাজ্যভিত্তিক বেসরকারি সংস্থা ইকোনমিস্ট ইন্টেলিজেন্স ইউনিট কর্তৃক ২০২৩ সালে ১৬৭টি দেশের মধ্যে সংকলিত ‘গণতন্ত্র সূচক’ অনুযায়ী বাংলাদেশের অবস্থান ৭৩। ১৬৭টি দেশের গড় মান যেখানে ৫, সেখানে বাংলাদেশের অর্জিত মান ৫.৯৯। আলোচ্য সূচকে আমেরিকার অবস্থান ২৫, ভারত ৪৬, পাকিস্তান ১০৭, নেপাল ও ভুটান যথাক্রমে ৯১ ও ৮৩। ২০০৭ ও ২০০৮ সালে গণতন্ত্র সূচকে বাংলাদেশের অবস্থান ছিল যথাক্রমে ৭৫ ও ৯১। যুক্তরাজ্যভিত্তিক প্রতিষ্ঠানটির হিসাব অনুযায়ী বাংলাদেশে গণতন্ত্র বিশ্বের গড় সূচকের চেয়ে অনেক দূর এগিয়ে এবং ক্রমান্বয়ে উন্নতির দিকে। অন্যভাবেও বিষয়টি বিবেচনা যোগ্য। গণতন্ত্রের বিপরীত মেরুতে অবস্থান করে কর্তৃত্ববাদী সরকার। কর্তৃত্ববাদী সরকার কাঠামোতে সামরিক সরকারগুলোই প্রধান ভূমিকা রেখে থাকে, যা বাংলাদেশে বিভিন্ন আবরণে ১৯৭৫ থেকে ১৯৯০ সাল পর্যন্ত চলমান ছিল। ১৯৯১ সাল থেকে সামরিক শাসনের অনুপস্থিতি বাংলাদেশে গণতন্ত্র বিকাশের ক্ষেত্রে অন্যরকম এক সাফল্য। ২০১৪ সালের নির্বাচনে বাংলাদেশের তৎকালীন প্রধান বিরোধী দল বিএনপি অংশ নিলে বাংলাদেশের গণতন্ত্র আরও সুসংহত হতো। ২০১৮ সালের নির্বাচনে বিএনপি অংশ নিলেও বিভিন্ন স্তরের কিছু অতি উৎসাহী ব্যক্তির কারণে হয়তো নির্বাচন প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে উঠেছিল। এক্ষেত্রে এককভাবে আওয়ামী লীগকে দোষারোপ করা সঠিক নাও হতে পারে। নির্বাচন পরিচালনায় সরকারের বিভিন্ন স্তরের পাশাপাশি নাগরিক হিসেবে কম-বেশি আমাদের সবারই দায়বদ্ধতা রয়েছে। তারপরও ভুলত্রুটি শুধরে গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে আগামী নির্বাচনগুলো পরিচালনা করতে রাষ্ট্রীয় স্বার্থকে গুরুত্ব দিয়ে সব দলকে একসঙ্গে কাজ করা উচিত। রাষ্ট্রযন্ত্র, দল ও সব পর্যায়ের নাগরিকের কাছেই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি হলো, রাষ্ট্রের স্বার্থকে সংরক্ষণ ও উন্নয়ন করা। আগামী জাতীয় নির্বাচন ঘিরে বাংলাদেশে এক ধরনের উন্মাদনা লক্ষণীয়। দেশের প্রধান দুটি দল আওয়ামী লীগ ও বিএনপির মধ্যে বিশ্বাস ও আস্থার সংকটই এ অবস্থার সৃষ্টি করেছে। গণতন্ত্রের উন্নয়ন ও উত্তরণে এহেন অবস্থা দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের ধারাবাহিকতা রক্ষায় অকল্পনীয় ক্ষতির কারণ হতে পারে। এ অবস্থার কারণে বিদেশি বন্ধু রাষ্ট্রগুলো বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ায় ‘কৌশলগত চাপ’ প্রয়োগ করে চলেছে, যা সার্বভৌম একটি রাষ্ট্রের জন্যে বিব্রতকর। ২০০৮ সালে বাংলাদেশের মাথাপিছু আয় ৪৮৬ মার্কিন ডলারের বিপরীতে বর্তমানে ২৮০০ ডলারে উন্নীত হয়েছে। ‘গণতন্ত্র সূচকে’ উন্নতির মতোই অর্থনৈতিক দিক দিয়েও বাংলাদেশ এগিয়ে চলেছে। নাগরিকদের মৌলিক চাহিদা মিটিয়ে বিশ্বে যখন বাংলাদেশ সম্মানজনক একটা অবস্থানে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করার প্রতিযোগিতায় লিপ্ত, সে সময়ে রাজনৈতিক দলগুলোর অনড় অবস্থান আমাদের মেধাবী ও উচ্চাকাঙ্ক্ষী তরুণ সমাজকে অনিশ্চিত ভবিষ্যতের দিকে ঠেলে দিতে পারে। এ অবস্থা একজন দেশপ্রেমিকের পক্ষে মেনে নেওয়া কষ্টকর। আগামী নির্বাচনে প্রধান একটি দলের সম্ভাব্য অনুপস্থিতি, সুষ্ঠু নির্বাচনে দুর্বলতা, ও রক্তক্ষরণ নিঃসন্দেহে নির্বাচনকে প্রশ্নবিদ্ধ করতে পারে। এক্ষেত্রে আমেরিকা ও তাদের মিত্র দেশগুলো যদি ‘ভিসা’ নিষেধাজ্ঞাসহ ‘বাণিজ্যিক’ বা আরও ‘কঠোরতম’ নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে সেক্ষেত্রে বাংলাদেশের সাধারণ মানুষগুলোর লাভ হবে কতটুকু? আমাদের গার্মেন্টস সেক্টরসহ অন্যান্য রপ্তানি বাণিজ্যে আলোচ্য নিষেধাজ্ঞা কী ধরনের ক্ষতির কারণ হয়ে উঠতে পারে, তা কি সংশ্লিষ্ট রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ ভেবে দেখেছেন কখনো? এহেন প্রেক্ষাপটে বেকারত্বের সংখ্যা বহুগুণ বৃদ্ধি পাবে, উন্নয়নের ধারাবাহিকতা বাধাগ্রস্ত হবে, অর্থনীতি ধসে যাবে ও আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি ঘটবে। এক্ষেত্রে শুধু কি আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীরাই পরিবর্তিত পরিস্থিতির শিকার হয়ে না খেয়ে দিন কাটাবে? বিরোধী দলগুলোর নেতাকর্মীরা কি উদ্ভূত পরিস্থিতিতে বিলাসবহুল জীবনযাপন করতে পারবে? সম্ভাব্য নিষেধাজ্ঞা আরোপের ফলে বাংলাদেশে কি রাতারাতি ‘পরিপূর্ণ গণতন্ত্র’ প্রতিষ্ঠিত হবে? এদেশের সাধারণ নাগরিক হিসেবে আমরা কি রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের কাছে রাষ্ট্রের স্বার্থকে সংরক্ষণ করতে বিনীতভাবে অনুরোধ করতে পারি না? ব্যক্তির চেয়ে দল বড় আর দলের চেয়ে রাষ্ট্র। রাষ্ট্রের স্বার্থকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে আগামী নির্বাচনে সব দলকেই নির্বাচনে অংশগ্রহণ করতে অনুরোধ করতে পারি না? সুষ্ঠু, সুন্দর ও উৎসবমুখর পরিবেশে ভোটাররা যেন তাদের সর্বোত্তম প্রতিনিধি নির্বাচিত করে বাংলাদেশের উন্নয়নের ধারা অব্যাহত রেখে আগামী দশকে বাংলাদেশকে উন্নত দেশে রূপান্তরিত করতে সবার সহযোগিতা কি চাইতে পারি না? বাংলাদেশের অর্থনৈতিক ও সামাজিক উন্নয়ন এখন সারা বিশ্বে প্রশংসিত। ইকোনমিস্ট ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের গণতন্ত্র সূচকেও বাংলাদেশের অবস্থান অতীতের চেয়ে এগিয়ে। এ সময়ে বাংলাদেশের সার্বভৌমত্বকে শ্রদ্ধা করে অর্থনীতির চাকা সচল রেখে বাংলাদেশকে উচ্চ-মধ্যম আয়ের দেশে উন্নীত করার লক্ষ্যে বিদেশি বন্ধুরা কি তাদের দায়িত্ব সঠিকভাবে পালন করতে পারে না? বাংলাদেশের মানুষের ধারাবাহিক উন্নয়নে তাদের বাস্তবসম্মত সহযোগিতা এ সময়ে আমাদের সবারই প্রার্থনা।

  • নিউজ ভিউ 936