logo

শিরোনাম

সাহিত্যের দখল নেবে কি কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা?

Bangalir Kantha
প্রতিবেদন প্রকাশ: ০২ এপ্রিল, ২০২৩ | সময়ঃ ১২:৫৫
photo
সাহিত্যের দখল নেবে কি কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা?

চ্যাটজিপিটি আসার পর হাল সময়ে তৈরি হয়েছে বড় প্রশ্ন, মানুষের লেখা সাহিত্য কি এবার শঙ্কার মুখে পড়বে? ভবিষ্যতে সাহিত্যের দখল নেবে কি কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা?

টাইমলাইন ২০১৬। শিনইচি হোশি সাহিত্য পুরস্কারের জন্য পাণ্ডুলিপি যাচাই–বাছাই চলছে। জাপানের বিখ্যাত বিজ্ঞান কল্পকাহিনি লেখক শিনইচি হোশির মৃত্যুর ১৭ বছর পর এ পুরস্কার প্রবর্তন করা হয়।

সে বছর জমা পড়া মোট পাণ্ডুলিপির সংখ্যা ছিল ১ হাজার ৪৫০। ১১টা পাণ্ডুলিপি প্রথম পর্বে মনোনীত হয়। এগুলোর মধ্যে একটা হলো ‘দ্য ডে আ কম্পিউটার রাইটস আ নভেল’।  

বিজয়ীর নাম ঘোষণা করার কিছুক্ষণ আগে বিচারকেরা আবিষ্কার করেন, এ উপন্যাস মানুষের লেখা নয়। ‘সেকাই ক্যামেরা’ নামের এক এআই (আর্টিফিশিয়াল ইন্টিলিজেন্স, বাংলায় যাকে বলা যেতে পারে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা) প্রোগ্রাম জিনিসটা লিখেছে। অবশ্য এর মধ্যে মানবিক টাচ বা স্পর্শ দিয়েছে একদল লেখক। সে যাত্রায় বিচারকেরা প্রতিযোগিতা থেকে উপন্যাসটাকে বাদ দেন।

এ কেলেঙ্কারি জাপানে এবং সারা বিশ্বে মনোযোগ সৃষ্টি করেছিল। জাপানি সাহিত্য সম্পর্কে নিয়মিত খোঁজখবর রাখার কারণে ঘটনাটা আমিও জানতাম। অবশ্য তখন আমি এটাকে বিশেষ গুরুত্ব দিইনি। কিন্তু আজ এই ২০২৩ সালে দাঁড়িয়ে যখন চ্যাটজিপিটি (জেনারেটিভ প্রিট্রেইনড ট্রান্সফরমার) নিয়ে সবাই কথা বলছে, তখন মনে পড়ে গেল ঘটনাটা। 

সাহিত্য পুরস্কারের বিচারকদের চোখ যদি এআই ফাঁকি দিতে পারে তো বলাই যায়, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা সফলভাবে উপন্যাস লিখতে সক্ষম। সে ক্ষেত্রে যাঁরা গল্প-উপন্যাস লিখছেন, তাঁদের ভবিষ্যৎ কী?

২০১৬ থেকে ২০২৩। এর মধ্যে প্রযুক্তির আরও উন্নতি হয়েছে। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার বিকাশে ঢালা হয়েছে কল্পনাতীত পরিমাণে অর্থ। এআই এখন আরও বেশি নিখুঁত, আরও কার্যকর। কিন্তু এতটা নিখুঁত কি হতে পেরেছে যে সাহিত্যিকদের জন্য হুমকির কারণ হবে?

ল্যাপটপ টেনে নিয়ে চ্যাটজিপিটিকেই প্রশ্নটা করলাম। আমাদের কথাবার্তা ইংরেজিতে হয়েছিল। আমি এখানে বাংলায় লিখছি। ওকে জিজ্ঞেস করলাম, তুমি কি মনে করো যে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা হিউম্যান রাইটারদের রিপ্লেস করতে পারবে?

এর আগের সেশনে আমরা মুরাকামি আর ইশিগুরোকে নিয়ে আলোচনা করেছিলাম। ঠিক সেই সূত্র ধরেই কথা শুরু করল ও। দ্রুত টাইপ করল, তুমি তো কাজুয়ো ইশিগুরোর লেখার সাথে পরিচিত, তাই না?

বললাম, হুম।

কাজুরা ইশিগুরোর একটা কোটেশন আছে, ‘শিল্পের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে ফ্রেম অব রেফারেন্স।’ কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার কোনো ফ্রেম অব রেফারেন্স নেই।

বুঝলাম না। ফ্রেম অব রেফারেন্স কী জিনিস? একটু বুঝিয়ে বলো।

সাহিত্যের ক্ষেত্রে ফ্রেম অব রেফারেন্স হলো একজন লেখক বা পাঠকের অভিজ্ঞতা, সাংস্কৃতিক পটভূমি ও শিক্ষা, যা তাকে কোনো সাহিত্যকর্মকে উপলব্ধি করতে সাহায্য করে। এই রেফারেন্সের মাধ্যমে বইয়ের থিম, চরিত্র ও ঘটনাগুলো লেখক বা পাঠকের কাছে প্রাসঙ্গিক হয়।

সে ক্ষেত্রে কি কৃত্রিম বৃদ্ধিমত্তা হুমকি নয় লেখকদের জন্য?

একেবারেই নয়।

আর একটু ব্যাখ্যা করবে?

নিজের কথা বলি। চ্যাটজিপিটি মানে আমি গ্রামাটিক্যালি নির্ভুল বাক্য লিখতে পারি, বাক্য অর্থপূর্ণ হয়। কিন্তু এটাই শেষ কথা নয়। আমি যে বাক্য লিখি, তাতে সৃজনশীলতা, এমপ্যাথি অর্থাৎ সহমর্মিতা এবং মানবিক বুদ্ধিমত্তার অভাব রয়েছে, যা গল্প লেখার জন্য অপরিহার্য। লেখা মানে তো শুধু শব্দগুলোকে একের পর এক বসিয়ে নির্ভুল বাক্য তৈরি করা নয়। ভালো গল্পে লেখক চরিত্রগুলোকে দরদ দিয়ে তৈরি করেন, প্লট সাজান এবং পাঠককে একটা ইমোশনাল জার্নির মধ্যে নিয়ে যান, তাদের আবেগ জাগিয়ে তোলেন। এগুলো কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার ক্ষমতার বাইরে।

আরেকটু বলো এ ব্যাপারে।

চ্যাটজিপিটি বেশ খানিকটা সময় নিয়ে ধীরে ধীরে টাইপ করল, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা কখনোই মৌলিক বা অরিজিনাল কনটেন্ট তৈরি করতে পারবে না। সে ক্ষমতাই তার নেই। সে বড়জোর মানুষের মতো লিখতে পারবে। একজন মানুষ হলে যেভাবে লিখত, সেই পথ আমি অনুসরণ করতে পারি, কিন্তু আমার পক্ষে কখনোই নতুন ধারণা বা দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে আসা সম্ভব নয়। যাঁরা লেখক তাঁরা তাঁদের অনন্য অভিজ্ঞতা, দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে আসতে পারেন লেখার মধ্যে। নিজের একটা স্বকীয় কণ্ঠস্বরে গল্প বলতে পারেন। আর এগুলোই সত্যিকার অর্থে একটা অরিজিনাল কনটেন্ট তৈরি করে। মৌলিক কিছু একটা সৃষ্টি হয়।

বললাম, এ ছাড়া আর কোনো পয়েন্ট মাথায় আসছে তোমার?

লেখালেখি হলো খুবই ব্যক্তিগত একটা কাজ। চিত্তাকর্ষক গল্প বলতে গেলে সেটার মধ্যে মানবিক একটা স্পর্শ দরকার হয়। আমি সেই টাচ দিতে অক্ষম। সৃজনশীলতা ও মৌলিকত্বকে প্রতিস্থাপন করা এত সোজা নয়।

সান্ত্বনা দেওয়ার জন্য এগুলো বলছ, না?

একেবারেই না। শোনো, অ্যান্ড্রু এনজির নাম শুনেছ? 

না। কে উনি?

একজন এআই বিশেষজ্ঞ। উনি বলেছেন, ‘কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা লেখকদের বাতিল করে দেবে না, তবে এটা সত্য যে এআই আসার পর আমরা আগে যেভাবে লিখতাম, সে পদ্ধতিতে কিছু পরিবর্তন আসবে। চ্যাট জিপিটি লেখকদের জন্য সহায়ক হবে, তাদের নতুন নতুন আইডিয়া দেবে, নির্দিষ্ট কিছু কাজকে স্বয়ংক্রিয় করে ফেলবে, পাঠপ্রতিক্রিয়া ও পরামর্শের মাধ্যমে তাঁদের লেখার উন্নতি করতে সাহায্য করবে।’

আরও নির্দিষ্ট করে বলবে, লেখকদের কী ধরনের সহায়তা করতে পারে চ্যাটজিপিটি?

অঙ্ক করার জন্য আমরা ক্যালকুলেটরের সাহায্য নিই, বানান সংশোধনের জন্য আছে স্পেল চেকার, ঠিক তেমনি আমাকেও সাহায্যকারী টুল হিসেবে সাহিত্যে ব্যবহার করা সম্ভব।

এটা আমার প্রশ্নের উত্তর হলো না। ফিল্ডগুলো স্পেসিফিক করে বলো, কীভাবে সাহায্য করবে?

এ কথার উত্তরে চ্যাটজিপিটি দ্রুত টাইপ করল, আমি সৃজনশীল লেখকদের বিভিন্ন উপায়ে সাহায্য করতে পারি, যার মধ্যে রয়েছে—

ব্রেইনস্ট্রমিং: তুমি যদি তোমার গল্পের প্লট বা চরিত্র নিয়ে দিশাহারা থাকো, আমার সাহায্য নিতে পারবে। আমি প্রথমে তোমার লক্ষ্য কী, সেটা জেনে নেব। তারপর তোমার আগ্রহ ও পছন্দের ভিত্তিতে পরামর্শ দেব, সাহায্য করব। রাইটারস ব্লকের ক্ষেত্রে এ প্রক্রিয়া দারুণ কাজ করবে।

প্রতিক্রিয়া: ধরো, তুমি তোমার গল্পের খসড়া লিখে ফেলেছ, তুমি আমাকে সেটা পড়তে দিতে পারো। আমি তোমার লেখার শৈলী, গতি, চরিত্রায়ণ ও প্লট ডেভেলপমেন্ট সম্পর্কে আমার মতামত জানাতে পারি। এ প্রতিক্রিয়া তোমাকে উন্নতি করতে সাহায্য করবে। কোথায় সংশোধন বা পরিমার্জন করতে হবে, সে ব্যাপারে পরামর্শ দিতে পারব।

লেখার প্রম্পট: তুমি যদি চাও তো আমি বিভিন্ন জনরার থিম ও লেখার শৈলীর ওপর প্রম্পট ও ডেমো দিয়ে সাহায্য করতে পারি।

গবেষণায় সাহায্য: তোমার গল্পে যদি কোনো নির্দিষ্ট বিষয় বা থিম নিয়ে গবেষণার দরকার পড়ে, তাহলে আমাকে সেটা বলতে পারবে। তোমার হয়ে কাজটা আমিই করব। প্রাসঙ্গিক তথ্য দিয়ে লেখাটা সমৃদ্ধ করতে পারব।

সম্পাদনা ও বানান সংশোধন: লেখা শেষ হওয়ার পর আমি তোমার পাণ্ডুলিপি সম্পাদনায় সাহায্য করতে পারি। বানান আর ব্যাকরণ ঠিক আছে কি না, তা দেখার ক্ষমতা আমার আছে। তোমার লেখা সুসম্পাদিত হবে আমি দেখে দিলে।

এ পর্যায়ে গিয়ে মনে হলো, অনেক পকপক হয়েছে। মাথা ধরে যাচ্ছে। চ্যাটজিপিটিকে ধন্যবাদ দিয়ে কথা শেষ করলাম। হাত-পা ছড়িয়ে বসলাম বারান্দায় গিয়ে।

আমার লেখালেখির বয়স বেশি দিন না, তবে লেখা শুরু করার অনেক আগে থেকেই বিশ্বাস করি, গল্প বলতে পারা সাধারণ কোনো ক্ষমতা নয়। চেতনার গভীর কোনো স্তরে গিয়ে একটা ভালো গল্প পাঠকের সঙ্গে সংযোগ ঘটায়।

যখন লিখতে শুরু করলাম, তখন মনে হলো, আমার যে অভিজ্ঞতাগুলো রয়েছে, সেগুলোর মধ্যে লুকানো জটিলতা খুঁজে বের করতে চাই। অনেকটা নিজেকেই বিশ্লেষণ করার মতো। মনের গভীরে যে প্রশ্নগুলো আছে, সেগুলোরই হয়তো উত্তর খুঁজি। আর এর মাধ্যমে আমি চারপাশের পৃথিবীকে আরেকটু সহজ করে বুঝতে পারি, এমনকি বিশৃঙ্খলা ও বিভ্রান্তির মধ্যেও অর্থ খুঁজে পাই।

প্রশ্ন হলো, আমি যে প্রক্রিয়ায় কাজটা করে চলেছি, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা কি আদৌ এটা করতে সক্ষম? একটা অ্যালগরিদমের পক্ষে কি সত্যিই মানুষের আবেগ ও অভিজ্ঞতার জটিলতা ধারণ করা সম্ভব? যদি আমাকেই উত্তরটা দিতে বলা হয় তো বলব, না।

চ্যাট জিপিটিও আমার এ বক্তব্যের সঙ্গে একমত। যদিও সে শব্দের পর শব্দ সাজিয়ে খুব সুন্দর বাক্যবিন্যাস করতে পারে, ব্যাকরণগতভাবে নির্ভুল সব বাক্য, কিন্তু ‘হিউমান টাচ’ বলে একটা ব্যাপার থেকেই যায়, যা কেবল একজন মহান লেখকই দিতে পারবেন।

আর সে কারণেই জাপানের দ্য ডে আ কম্পিউটার রাইটস আ নভেল উপন্যাসে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার বাইরেও কিছু লেখকের সাহায্য নিতে হয়েছিল। ওই ঘটনার বহুদিন পর লস অ্যাঞ্জেলেস টাইমস তদন্ত করে বের করেছে, এআই লিখেছিল মাত্র ২০ শতাংশ। ওই উপন্যাসের ৮০ শতাংশই মানুষের লেখা।

লেখালেখি এক গভীর ব্যক্তিগত কাজ। একজন লেখক যখন লেখেন, তখন তাঁর স্বতন্ত্র অভিজ্ঞতা ও দেখার চোখকে ব্যবহার করেন, নিজস্ব বলার ভঙ্গি কাজে লাগান। তাঁর নিজেরই কণ্ঠস্বর কোনো না কোনোভাবে ফুটে ওঠে লেখায়। এআই এ ক্ষেত্রে অপারগ।

তাহলে কি সাহিত্যজগতে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার কোনো স্থান নেই?

আছে। আমি বিশ্বাস করি, একজন লেখক যদি চ্যাটজিপিটিকে সাহায্যকারী টুল হিসেবে ব্যবহার করেন, তবে তাঁর প্রোডাক্টিভিটি বা উৎপাদনক্ষমতা বৃদ্ধি পাবে।

প্রযুক্তি মানেই শত্রু নয়, আবার সে বন্ধুও নয়। তাকে বন্ধু করে নিতে হয়।

  • নিউজ ভিউ 1017