সরকারি নিয়মকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে মানিকগঞ্জের শিবালয়ের যমুনা ও পাটুরিয়ার ভাটিতে পদ্মা নদীর তীরবর্তী বিভিন্ন এলাকায় দেশীয় পদ্ধতিতে তৈরি ড্রেজার মেশিন দিয়ে অবৈধভাবে এবং প্রকাশ্যে মাটি কাটার মহোৎসব চলছে। বালু লুটেরারা কোন কিছুরই তোয়াক্কা করছে না। বিআইডব্লিউটিএর ফোরশো এরিয়ার এবং ঘাট এলাকারসহ কোন জমিই বাদ পড়ছে না এসব ভূমি খেকোদের হাত থেকে।
অনেক সময় প্রশাসনের চোখ ফাঁকি দিতে মাটি কাটার সময় পরিবর্তন করে বালু লুটেরার দল। এসব লুটেরার দল যেকোন উপায়ে সবাইকে ম্যানেজ করে প্রকাশ্যে দিবালোকে নদীতীরের বালু মাটি কাটছে। উপজেলা প্রশাসনের চোঁখ এড়ানোর জন্য স্থানীয় প্রভাবশালীরা রাতের আঁধারে দীর্ঘদিন ধরে মাটি কেটে বিক্রি করছে। রাতের বেলা মাটি কাটার কারণে ড্রেজারের বিকট শব্দে ঘুমাতে পারছেন না বলে অভিযোগ করেছেন নদীপারে বসবাসকারী লোকজন।
তারা বলেছেন, এভাবে বালু মাটি কাটা অব্যাহত থাকলে আগামী বর্ষায় নদীর পাড় এলাকার ঘর-বাড়িসহ অন্য সরকারি স্থাপনা মারাত্মকভাবে নদীভাঙনের কবলে পড়বে। যার মধ্যে দেশের উত্তারঞ্চলের বিদ্যুৎ সরবরাহের খুঁটিও রয়েছে। সরেজমিন শিবালয়, জাফরগঞ্জ, তেওতা, অন্বয়পুর, এলাচিপুরসহ দশটি গ্রাম ঘুরে দেখা গেছে শতাধিক দেশীয় মাটি কাটার ড্রেজার নদীতে লাগিয়ে মাটি কাটার দৃশ্য। সব দেখে শুনে মনে হয়েছে এ যেন সরকার ঘোষিত এবং ইজারাকৃত কোন বালু মহালের বালু মাটি কাটার দৃশ্য এগুলো।
শিবালয় উপজেলার তেওতা ইউনিয়নের জাফরগঞ্জ থেকে আরুয়া ইউনিয়নের বরুলিয়া পর্যন্ত নদীর তীরবর্তী এলাকায় ঘুরে ১১০টি মাটি কাটার দেশীয় ড্রেজার দেখা গেছে। এরমধ্যে তেওতা ইউনিয়নে দেশীয় ড্রেজার রয়েছে সবচেয়ে বেশি। যেসব ড্রেজারের মালিক মাসুদ, মিজান, ওসিউর রহমান, ফারুক, জালাল, হালিম, মুক্তার, রহিম মোল্লা, আবদুর কাদের, বিশু বিশ্বাস, মুন্না, মনির, আবদুল করিম, নান্নু, নুরে আলম, হারুন, লুফর, মিন্টু, দেলোয়ার, জসিম, মুন্তাজ, আহাদ, সুজন, মিলন কাজী, কিবরিয়া ও আবুল মিয়াদের সঙ্গে কথা বলতে চাইলে তারা ‘পরে দেখা করবো’ বলে এড়িয়ে গেছেন। এলাকার চিহ্নিত প্রভাবশালী সবাইকে ম্যানেজ করেই অবৈধ এই মাটির ব্যবসা পরিচালনা করা হচ্ছে বলে বিশ^স্ত সূত্রে জানা গেছে। এছাড়া আরিচা-পাটুরিয়া বন্দর ও ঐতিহ্যবাহী আরিচা ঘাটের পাশে যমুনা নদী থেকে ড্রেজার দিয়ে অবৈধভাবে বালু উৎত্তোলনের মহোৎসব চলছে।
ফলে হুমকির মুখে পড়েছে আরিচা ঘাট, আরিচা বন্দর ও তেওতা-জাফরগঞ্জ বেড়িবাঁধসহ আশপাশের গ্রামগুলো। দীর্ঘদিন ধরে এক শ্রেণীর মাটি লুটেরারা রাজনৈতিক প্রভাব বিস্তার করে ড্রেজার বসিয়ে নদী থেকে কোটি কোটি ঘনফুট বালু মাটি উত্তোলন করে প্রতি মাসে কোটি টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে। অথচ এসব এলাকা বালু মহাল ঘোষণা করে সরকারিভাবে ইজারা দিলে সরকার কোটি টাকা রাজস্ব আদায় করতে পারত। কিন্তু রহস্যজনক কারণে তা না করে অবৈধভাবে বালু মাটি কাটার সুযোগ দিয়ে সরকারকে কোটি টাকা রাজস্ব বঞ্চিত করা হচ্ছে এবং অন্যদিকে গুরুত্বপূর্ণ বন্দরসহ কয়েকটি গ্রামকে নদী ভাঙনের মুখে ঠেলে দেয়া হচ্ছে। এসব কারণে জনরোষ উঠছে সরকারের বিরুদ্ধে।
আরিচাঘাট, তেওতা, জাফরগঞ্জ, ষাইটঘর, মান্দ্রখোলাসহ বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, শিবালয় উপজেলার পাটুরিয়া ঘাট এলাকা থেকে জাফরগঞ্জ এলাকা পর্যন্ত প্রায় ৬৫টি ড্রেজার বসানো হয়েছে। এসব ড্রেজার দিয়ে সুযোগ মতো ব্যাপক হারে বালু উত্তোলন করে বিক্রি করা হচ্ছে।
সংশ্লিষ্ট এলাকার স্থানীয় কিছু চিহ্নিত ব্যক্তি রাজনৈতিকভাবে প্রভাবশালী হওয়ায় স্থানীয় উপজেলা প্রশাসনের ইচ্ছে থাকলেও কোন প্রতিকারমূলক পদক্ষেপ নিতে পারছেন না বলে নির্ভরযোগ্য একটি সূত্র জানিয়েছে। অন্যদিকে কিছু এলাকাবাসী অভিযোগ করেছেন প্রশাসনকে ম্যানেজ করেই তারা এই অবৈধ কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে। কোন বাধা না থাকায় বালু মাটি লুটেরারা প্রতিযোগিতামূলক বালু উত্তোলন করায় নদীপার এলাকার বেড়িবাঁধসহ অন্য স্থাপনা মারাত্মক হুমকির মুখে পড়ছে।
এসব দেখে নাম প্রকাশ না করার শর্তে শিবালয়ের সরকারদলীয় এক নেতা বলেন, যেভাবে নদীর পাড় হতে মাটি কাটা হচ্ছে তাতে মনে হয় এটা সরকারি ইজারা দেয়া কোন বালুমহাল। সরকারদলীয় প্রভাবশালী কিছু লোক প্রশাসনকে ম্যানেজ করে আরিচা বন্দর সংলগ্ন যমুনা নদীতে ড্রেজার বসিয়ে রাত-দিন অবৈধভাবে বালু মাটি কেটে বাণিজ্যিকভাবে বিক্রি করছে। রহস্যজনক কারণে স্থানীয় প্রশাসন এসব অপকর্ম না দেখার ভান করছে বলেও তিনি মন্তব্য করেন।
আরিচা ঘাট সংলগ্ন যমুনা নদীর পাড় এলাকা থেকে অবৈধভাবে মাটি কাটার ফলে বর্ষা মৌসুমে নদী ভাঙনের সম্ভাবনা রয়েছে বলে এলাকাবাসী জানান। কারণ হিসেবে তারা বলছেন, সব সময় নদীর নিচু এলাকা দিয়েই পানির প্রবাহ বইতে থাকে। তাই বর্ষার সময় পানির প্রবল স্রোতে নদীর পাড় এলাকায় ভাঙন দেখা দিতে পারে।
আর এলাকায় একবার নদীভাঙন শুরু হলে ঐতিহ্যবাহী আরিচা বন্দর, শিবালয় বন্দর বাজার, আবহাওয়া অফিস, প্রধানমন্ত্রীর প্রস্তাবিত বিদ্যুৎ প্লান্ট, পিসিপোল নির্মাণ প্লান্ট, তেওতা-জাফরগঞ্জ, আরিচা-দাসকান্দী বেড়িবাঁধ কাম সড়ক এবং বিআইডব্লিউটিএ, বিআইডব্লিউটিসি অফিস, শিবালয় থানা ভবন, ইউনিয়ন পরিষদ ভবন, সরকারি ডাকবাংলো ও তিনটি হাইস্কুল একটি কলেজ, মসজিদ মাদ্রাসাসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ছাড়াও স্থাপিত বিদ্যুৎ লাইনের খুঁটি (টাওয়ার) এবং নদী সংলগ্ন আশপাশের গ্রামগুলো নদীতে বিলীন হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনায় এলাকাবাসীর মধ্যে চরম আতঙ্ক বিরাজ করছে।
এসব বিষয়ে দক্ষিণ তেওতা গ্রামের কাউছার শেখ জানান, যাদের কোন জায়গা জমি নেই তারাই সরকারদলীয় প্রভাব খাটিয়ে নদী থেকে অবৈধভাবে মাটি কেটে বিক্রি করছে। প্রভাবশালীদের ভয়ে সাধারণ লোকজন তাদের কিছু বলতে সাহস পায় না। শিবালয় বন্দরের ব্যবসায়ী সমাজ কল্যাণ সমিতির প্রাচার সম্পাদক শহিদুল ইসলাম জানান, অবৈধভাবে ড্রেজার বসিয়ে যেভাবে নদী থেকে মাটি কাটা হচ্ছে তাতে বর্ষা মৌসুমে নদীভাঙনের সম্ভাবনা রয়েছে। জরুরিভাবে এর প্রতিকারে কর্তৃপক্ষের ভূমিকা নেয়া প্রয়োজন হয়ে পড়েছে।
শিবালয় ইউনিয়নের ১নং ওয়ার্ড সদস্য রফিকুল ইসলাম জানান, বিগত দিনে দেখা গেছে নদী থেকে কেউ মাটি কাটলে বন্দর কর্তৃপক্ষ কোদাল (মাটি কাটার সরঞ্জাম) কেড়ে নিয়ে গেছে এবং পুলিশ দিয়ে হয়রানি করেছে। কিন্তু এবার নিহালপুরসহ বিভিন্ন এলাকায় বেশকিছু ড্রেজার দিয়ে অবৈধভাবে মাটি কেটে বিক্রি করছে একটি চক্র। দিন-রাত লাখ, লাখ ঘনফুট মাটি কাটা হলেও কারো কোন মাথাব্যথা নেই। প্রশাসনের এমন উদাসীনতার ব্যাপারে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, যারা এই মাটি কাটছে তারা নাকি ক্ষমতাসীন দলের নেতাকর্মী! ফলে কেউ কিছু বলতে সাহস পাচ্ছেন না।
এই বিষয়ে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা বলেন, স্থানীয়রাও তো এগুলো প্রতিকার করতে পারে। এছাড়া তিনি কোথায় ড্রেজিং চলছে তার লোকেশন জানতে চান।
এসব বিষয়ে মানিকগঞ্জ জেলা প্রশাসক বলেন, অবৈধ ড্রেজিংয়ের ব্যাপারে প্রতিদিন অভিযান পরিচালনা করে জরিমানা করা হচ্ছে। এসব অবৈধ ড্রেজার উচ্ছেদে আমাদের অভিযান অব্যাহত থাকবে।