বাংলাদেশে জাপানি কোম্পানির সংখ্যা বর্তমানে ৩২৪টি। তার মধ্যে কিছু বন্ধ। গত সেপ্টেম্বর পর্যন্ত জাপানি কোম্পানিগুলো বাংলাদেশে প্রায় ৪৬ কোটি মার্কিন ডলারের বিনিয়োগ করেছে। ডলারের বর্তমান বাজারদর অনুযায়ী, দেশীয় মুদ্রায় জাপানি এ বিনিয়োগের পরিমাণ ৪ হাজার ৯০৭ কোটি টাকা। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যানুযায়ী, দেশের নির্মাণ খাতে সর্বোচ্চ পাঁচ কোটি ডলারের বিনিয়োগ করেছে জাপানি কোম্পানি। পোশাক ও বস্ত্র খাতে বিনিয়োগ ৪ কোটি ৮২ লাখ। বিদ্যুৎ খাতে বিনিয়োগের পরিমাণ আড়াই কোটি ডলার। এর বাইরে গ্যাস ও পেট্রোলিয়াম, ট্রেডিং, রাসায়নিক ও ওষুধ, চামড়া ও চামড়াজাত পণ্যসহ বিভিন্ন খাতে বিনিয়োগ করেছে জাপানি কোম্পানি।
এখন প্রশ্ন জাগতে পারে বাংলাদেশে বিনিয়োগ করা জাপানি কোম্পানিগুলো কেমন ব্যবসা করছে। এশিয়া ও ওশেনিয়া অঞ্চলে জাপানি কোম্পানিগুলোর ব্যবসার পরিস্থিতি নিয়ে গত বছরের আগস্ট-সেপ্টেম্বরে একটি সমীক্ষা করেছে জাপান এক্সটারনাল ট্রেড অর্গানাইজেশন (জেট্রো)। এতে বাংলাদেশে থাকা ৭৪টি জাপানি কোম্পানি অংশ নেয়। সমীক্ষার প্রতিবেদন গত ফেব্রুয়ারিতে প্রকাশ করা হয়।
সমীক্ষার প্রতিবেদন অনুযায়ী, বাংলাদেশে ব্যবসারত লাভজনক জাপানি কোম্পানির সংখ্যা বেড়েছে। ২০২১ সালে ৪৩ দশমিক ২ শতাংশ কোম্পানি মুনাফা করেছিল। গত বছর সেটি বেড়ে ৪৭ দশমিক ৩ শতাংশ হয়েছে। তার বাইরে না মুনাফা না লোকসান এমন অবস্থায় রয়েছে ২০ শতাংশ জাপানি কোম্পানি। যদিও গত বছর ৩২ দশমিক ৭ শতাংশ কোম্পানি লোকসান করেছে। এদিকে ২০২১ সালের তুলনায় গত বছর পরিচালন মুনাফা বাড়বে বলেও সমীক্ষাকালে পূর্বাভাস দিয়েছিল ৪৮ দশমিক ২ শতাংশ জাপানি কোম্পানি। আর ২০২২ সালের তুলনায় চলতি বছর পরিচালন মুনাফা বৃদ্ধি পাবে এমন আশাবাদ জানিয়েছে ৬১ দশমিক ৮ শতাংশ কোম্পানি। গত বছরের মতো চলতি বছরও একই মুনাফা থাকবে এমন অনুমানের কথা বলেছিল ৩৬ দশমিক ৪ শতাংশ কোম্পানি। আর মুনাফা কমতে পারে বলে শঙ্কার কথা জানিয়েছে ১ দশমিক ৮ শতাংশ কোম্পানি।
সমীক্ষা প্রতিবেদনে শুধু লাভ-লোকসান নয়, আগামী এক-দুই বছরে বাংলাদেশে ব্যবসা সম্প্রসারণের পরিকল্পনার কথাও জানিয়েছে ৭১ দশমিক ৬ শতাংশ কোম্পানি। ব্যবসা সম্প্রসারণের পরিকল্পনার ক্ষেত্রে বাংলাদেশের ওপরে রয়েছে শুধু ভারত। আর বাংলাদেশের নিচে রয়েছে ভিয়েতনাম, লাওস, কম্বোডিয়া, দক্ষিণ কোরিয়া, মালয়েশিয়া, তাইওয়ান, সিঙ্গাপুরসহ এশিয়া ও ওশেনিয়া অঞ্চলের আরও বেশ কিছু দেশ। অর্থাৎ জাপানি কোম্পানিগুলো ব্যবসা সম্প্রসারণের পরিকল্পনায় এগিয়ে রেখেছে ভারত ও বাংলাদেশকে।
এদিকে গত মাসে ভারত সফর করেছেন জাপানের প্রধানমন্ত্রী ফুমিও কিশিদা। নয়াদিল্লির সপ্রু হাউসে ইন্ডিয়ান কাউন্সিল অব ওয়ার্ল্ড অ্যাফেয়ার্স ভাষণে তিনি বলেন, ‘ভারতের প্রতিবেশী রাষ্ট্র বাংলাদেশ শিগগিরই মধ্যম আয়ের দেশে উন্নীত হবে। বিষয়টি আমাদের দৃষ্টিতে রয়েছে। বাংলাদেশের সঙ্গে অর্থনৈতিক সহযোগিতা চুক্তির সম্ভাবনা কতখানি, তা খতিয়ে দেখতে আমরা ইতিমধ্যে এক যুগ্ম স্টাডি গ্রুপ গঠন করেছি।’
জাপানের প্রধানমন্ত্রী আরও বলেন, দক্ষিণ এশিয়ার স্থিতিশীলতার স্বার্থে জাপান ও ভারত ঘনিষ্ঠ সহযোগী। বাংলাদেশ ও ভারতের সঙ্গে সহযোগিতার মধ্য দিয়ে জাপান বঙ্গোপসাগরীয় অঞ্চল ও উত্তর-পূর্ব ভারতে শিল্পোন্নয়নে জোর দেবে। সে ক্ষেত্রে বাংলাদেশের সঙ্গে জাপান অর্থনৈতিক অংশীদারি গড়ে তুলতে আগ্রহী।
নারায়ণগঞ্জের আড়াইহাজারে এক হাজার একর জমির ওপর নির্মাণাধীন জাপানি অর্থনৈতিক অঞ্চলে দেশটির বড় বিনিয়োগ আসার সম্ভাবনা রয়েছে। জাপানের সুমিতমো করপোরেশনের সঙ্গে যৌথভাবে এই অর্থনৈতিক অঞ্চল গড়ে তুলছে বাংলাদেশ অর্থনৈতিক অঞ্চল কর্তৃপক্ষ (বেজা)।
বেজা সূত্রে জানা যায়, এই অর্থনৈতিক অঞ্চলে কারখানা করতে জাপানের লায়ন করপোরেশন, ওনোদা, নিক্কা কেমিক্যালসহ পাঁচটি কোম্পানি চুক্তি করেছে। এ ছাড়া ৪০টি কোম্পানি সেখানে বিনিয়োগের আগ্রহ দেখিয়েছি। তার মধ্যে জাপানি কোম্পানির সংখ্যা ৩০টি।
এমন প্রেক্ষাপটে বর্তমানে জাপান সফরে রয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। প্রধানমন্ত্রীর চার দিনের এ সফরে কৃষি, মেট্রোরেল, শিল্পোন্নয়ন, জাহাজ রিসাইক্লিং, শুল্কসংক্রান্ত বিষয়, মেধাস্বত্ব, প্রতিরক্ষা সহযোগিতা, আইসিটি ও সাইবার নিরাপত্তা সহযোগিতাসংক্রান্ত বেশ কয়েকটি চুক্তি হয়েছে।
জানতে চাইলে জাপান বাংলাদেশ চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (জেবিসিসিআই) সাবেক মহাসচিব তারেক রাফি ভূঁইয়া গতকাল বুধবার প্রথম আলোকে বলেন, বর্তমানে জাপানি কোম্পানিগুলো মূলত অবকাঠামো নির্মাণ খাতে বিনিয়োগে আগ্রহ দেখাচ্ছে। কারণ, জাপানের সহযোগিতায় মাতারবাড়ী গভীর সমুদ্রবন্দর, মেট্রোরেলের মতো বেশ কয়েকটি বড় অবকাঠামো প্রকল্প নির্মাণাধীন রয়েছে। তিনি আরও বলেন, ‘বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বাজার বড় হচ্ছে।
বর্তমানে বৈশ্বিক অস্থিরতার কারণে অবকাঠামোর বাইরে জাপানি বিনিয়োগ না দেখলেও আগ্রহ দেখতে পাচ্ছি আমরা। এটি আমাদের জন্য খুবই ইতিবাচক। তবে এ বিনিয়োগ আনতে দীর্ঘ মেয়াদের জন্য কর ও ভ্যাটের হার নির্ধারণ করতে হবে।’